শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: করোনাকালে নিম্নমানের সাধারণ মাস্ককে ‘এন-৯৫ মাস্ক’ লিখে কেন্দ্রীয় ঔষধাগারে (সিএমএসডি) সরবরাহ করে আলোচনায় এসেছে জেএমআই হসপিটাল রিকুয়েস্টিং ম্যানুফ্যাকচারিং লিমিটেড। এন-৯৫ মাস্ক কেলেঙ্কারির ওই অভিযোগ অনুসন্ধানে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবদুর রাজ্জাকে ‘অতীব জরুরি তলব’ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। আজ বুধবার তার কমিশনে হাজির হয়ে বক্তব্য দেওয়ার কথা।

সাধারণ মাস্কের প্যাকেটে এন-৯৫ মাস্ক লেখায় জেএমআইকে কারণ দর্শানোর নোটিস দিয়েছিল সিএমএসডি। প্রতিষ্ঠানটি যে জবাব দিয়েছে তা গ্রহণযোগ্য নয় উল্লেখ করে কেন এই কোম্পানির বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না তার জন্য লিখিত ব্যাখ্যা চায় সিএমএসডি। জেএমআই ব্যাখ্যা দিলেও তাদের কাছ থেকে পণ্য নেওয়া বন্ধ রেখেছে সিএমএসডি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ও এন-৯৫ মাস্ক জালিয়াতির বিষয়টি তদন্ত করে। তদন্তে জানা যায় ‘মুন্সীগঞ্জের একটি কারখানায় অনুমোদনহীন সরঞ্জাম দিয়ে সাধারণ মাস্ক তৈরি করে সেগুলোতে এন-৯৫ লিখে সরবরাহ করে জেএমআই, যা করোনা প্রতিরোধে কোনো ধরনের ভূমিকা রাখতে সক্ষম নয়।’

অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে গত মঙ্গলবার আবদুর রাজ্জাকের মোবাইলে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি সাড়া দেননি। পরে বক্তব্য জানতে চেয়ে খুদেবার্তা পাঠানো হলেও তিনি জবাব দেননি। সিএমএসডির সাবেক পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শহীদুল্লাহ গত ৩০ মে জনপ্রশাসন সচিবকে যে চিঠি লেখেন তাতে জেএমআইর এন-৯৫ মাস্ক জালিয়াতির কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, চিকিৎসাসামগ্রী প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান জেএমআই কভিড সংক্রমণের শুরু থেকে হ্যান্ড গ্লাভস, স্যানিটাইজার ও সাধারণ মাস্ক সিএমএসডিকে সরবরাহ করে। ওই কোম্পানি সাধারণ মাস্কের প্যাকেটে এন-৯৫ লেখা সংবলিত মাস্ক দেয়। পরে কয়েকটি হাসপাতাল থেকে বিষয়টি সিএমএসডিকে জানানো হয়।

তাৎক্ষণিকভাবে মাস্কগুলো যে ‘সাধারণ মাস্ক’ তা জানানো হয় এবং ফেরত দেওয়ার অনুরোধ করা হয়। সিএমএসডি তাৎক্ষণিকভাবে জেএমআইকে তাদের সরবরাহ করা মাস্ক ফেরত নিতে আদেশ দেয় এবং সাধারণ মাস্কে কেন এন-৯৫ লেখা মোড়ক দেওয়া হয়েছে তার লিখিত ব্যাখ্যা চাওয়া হয়। জেএমআই লিখিত ব্যাখ্যা দেয় এবং সিএমএসডি তাৎক্ষণিকভাবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে বিষয়টির ব্যাখ্যা দেয়, যাতে এ ধরনের কোনো বিভ্রান্তি দেখা না দেয়।

জেএমআইর ভুল সংবলিত ব্যাখ্যা সিএমএসডি গ্রহণ করেনি এবং কেন এই কোম্পানির বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না তার লিখিত ব্যাখ্যা দিয়ে ৭ কর্মদিবসের মধ্যে জবাব দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। পরে জেএমআই তার ব্যাখ্যা দেয়। সিএমএসডি এই ধরনের অনভিপ্রেত ঘটনার জন্য এবং জাতীয়ভাবে বিভ্রান্তিমূলক কর্মকা-ের জন্য তাদের সরবরাহ বন্ধ রাখার বিষয়ে মতামত, সুপারিশসহ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয়। এরপর জেএমআইর মাস্ক বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে।’

চিঠিতে ব্রিগেডিয়ার শহীদুল্লাহ দাবি করেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি তড়িঘড়ি করে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সঠিকভাবে তদন্ত করেনি। তারা জেএমআই থেকে কেন এন-৯৫ লেখা সংবলিত মোড়কে মাস্ক সরবরাহ করেছে তার তদন্ত না করে সিএমএসডির ওপর এককভাবে দোষ চাপিয়ে তদন্তকাজ সমাপ্ত করে। যার প্রতিবেদন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিবের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে পাঠানো হয়। এ ধরনের কার্যক্রমে এক ধরনের সিন্ডিকেট জড়িত।’

অনুসন্ধানে জানা গেছে, সিএমএসডি থেকে চিকিৎসকদের জন্য নিম্নমানের ফেস মাস্ক পাঠানো হয় বিভিন্ন হাসপাতালে। এসব পণ্য ক্রয় ও সংগ্রহের সময় কোনো মান যাচাই করা হয়নি। এ নিয়ে সারা দেশের চিকিৎসকদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়। চিকিৎসকরা বলেন, সিএমএসডি থেকে সরবরাহকৃত মাস্ক অত্যন্ত নিম্নমানের ও কভারের ওপর এন-৯৫ লেখা থাকলেও ভেতরে ছিল সাধারণ ফেস মাস্ক, যা কোনো ভাইরাস প্রতিরোধে ভূমিকা রাখতে সক্ষম নয়। এ ধরনের মাস্ক চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মীদের করোনাভাইরাস থেকে কোনো নিরাপত্তা দেবে না। এসব মাস্ক ব্যবহার অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। সরকারি-বেসরকারি একটি প্রভাবশালী চক্র করোনা দুর্যোগকে ব্যবহার করে বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়েছে বলেও অভিযোগ করেন চিকিৎসকরা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, নিম্নমানের মাস্ক গ্রহণে অস্বীকৃতি জানানোর কারণে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. মঞ্জুর মোর্শেদকে বদলি করা হয়। মুগদা হাসপাতালে ৩০০ মাস্ক দেওয়া হয়। যেগুলোর মোড়কে ‘এন-৯৫ ফেস মাস্ক’ লেখা ছিল। মাস্কগুলো মানসম্মত না হওয়ায় মুগদা জেনারেল হাসপাতালের তৎকালীন পরিচালক শহিদ মো. সাদিকুল ইসলাম স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে চিঠি দিয়ে সেগুলো গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান।

বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস সংক্রমণের চিকিৎসার ক্ষেত্রে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের এন-৯৫ মাস্ক পরার পরামর্শ দেওয়া হয়। সরকার চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রীর (পিপিই) যুক্তিসঙ্গত ব্যবহার নিয়ে যে নীতিমালা প্রণয়ন করেছে তাতে অন্যান্য সুরক্ষাসামগ্রীর সঙ্গে এন-৯৫ মাস্ক বা এফএফপি-২ মানের অথবা সমমানের মাস্ক পরার কথা বলা আছে।

জেএমআইর মাস্ক জালিয়াতির বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটি তিনটি সুপারিশ করে। মাস্কগুলো আসল এন-৯৫ নয় এমন সন্দেহ থাকার পরও কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের পরিচালককে অবহিত না করেই যারা সেগুলো সরবরাহকারীর কাছ থেকে বুঝে নিয়েছেন সংশ্লিষ্ট সেই কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। পিপিইর চাহিদা ও বণ্টন প্রক্রিয়া শনাক্ত করতে দক্ষ জনশক্তি বাড়ানো এবং এন-৯৫ মাস্কের অনুমোদন, উৎপাদন ও বিপণনে সংশ্লিষ্ট কর্র্তৃপক্ষকে আরও সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী জেএমআইর এন-৯৫ মাস্কগুলো আমদানিকৃত অনুমোদনহীন কাঁচামাল দিয়ে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ার একটি কারখানায় তৈরি করা। তবে তদন্ত প্রতিবেদন সরবরাহকারীর বিরুদ্ধে কোনো শাস্তির সুপারিশ করেনি।

নিম্নমানের মাস্ক সরবরাহের বিষয়ে গত এপ্রিলে জেএমআইয়ের এমডি আবদুর রাজ্জাক এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানান, তারা এন-৯৫ মানের মাস্ক তৈরির প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। মহামারীর কারণে বিশ্বব্যাপী লকডাউন না হলে এই প্রক্রিয়া এত দিনে সম্পন্ন হয়ে যেত। যখন কোনো পণ্য গবেষণা ও উন্নয়নের পর্যায়ে চলে আসে, তখন আমরা আগে থেকেই এর জন্য কার্টন, প্যাকেট ও লিফলেট তৈরি করে ফেলি। যদি পণ্যটি অনুমোদন না পায় সেক্ষেত্রে কার্টন বা প্যাকেটগুলো নষ্ট করে ফেলি।

জেএমআইয়ের কর্মচারীদের ভুলের জন্য এভাবেই আগে থেকে তৈরি করে রাখা এন-৯৫ মাস্কের প্যাকেটে ২০ হাজার ৬০০ সাধারণ মাস্ক সরবরাহ করা হয়। আবদুর রাজ্জাকের দাবি, ‘আমরা এটি লক্ষ করিনি এবং এন-৯৫ মাস্কের হিসেবে কোনো বিলও জমা দেইনি। সুতরাং, আমরা এন-৯৫ মাস্কের কোনো কার্যাদেশ পাইনি এবং সরবরাহও করিনি।’

কে এই রাজ্জাক : নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলার আজিজপুর গ্রামের প্রয়াত শফিউল্লাহ মাস্টারের ছেলে আবদুর রাজ্জাক ১৯৮৯ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এমএসএস পাস করেন। তিনি জেএমআই গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা এমডি। জেএমআই অটো ডিজেবল সিরিঞ্জের মাধ্যমে সারা দেশে ০-১২ বছরের সব শিশুর টিকাদান কর্মসূচির আওতায় আনা হয়, যা ২০০৭ সালে শুরু হয়ে এখনো চলছে। তিনি ১৯৯৯ সালে দক্ষিণ কোরিয়া সরকারের সহযোগিতায় জেএমআই সিরিঞ্জ এবং মেডিকেল ডিভাইসেস লিমিটেড প্রতিষ্ঠা করেন।

১৯৯৯ সালেই তিনি জেএমআই হসপিটাল রিকুয়েস্টিং ম্যানুফ্যাকচারিং লিমিটেড প্রতিষ্ঠা করেন। ২০১৫ সালে পান ‘সিআইপি’ মর্যাদা। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন ফর মেডিকেল ডিভাইসেস অ্যান্ড সার্জিক্যাল ইনস্ট্রুমেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টারের সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজের সদস্য।