শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: পুঁজিবাজারের ধারাবাহিক মন্দা পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকারীদের পুঁজি হারানোর পাশাপাশি লোকসানে পড়েছে ব্রোকারেজ হাউজগুলো। এ মুহূর্তে প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসা করে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ, অফিস ভাড়া ও অন্যান্য খরচ দিতেও হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের। ফলে বেশকিছু ব্রোকারেজ হাউজের শাখা বন্ধের বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করছেন সংশ্লিষ্ট মালিকরা।

এদিকে দেশে করোনাভাইরাসের প্রভাব মোকাবিলায় গত ২৬ মার্চ থেকে শেয়ার বাজার বন্ধ রয়েছে। আগামী ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত চতুর্থ দফায় সরকারের সাধারণ ছুটির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। দেশে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে শেয়ার বাজারের লেনদেন চালু করা হবে। তবে করোনার প্রভাবে সাধারণ ছুটি দীর্ঘমেয়াদ বাড়লে ব্রোকারেজ হাউজগুলোর ব্যবসা বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়বে। তবে মালিকরা বলছেন, শিগগিরই শেয়ার বাজার পরিস্থিতি উন্নতি না হলে প্রতিষ্ঠান বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে বাধ্য হয়ে কর্মী ছাঁটাইসহ ব্যবসা বন্ধ করতে হতে পারে।

বিগত বছরগুলোতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও শেয়ার বাজার স্বাভাবিক পর্যায়ে আসেনি। ফলে অধিকাংশ কার্যদিবসে হাউজগুলোর আর্থিক হিসাবে লোকসান গুনতে গুনতে হয়েছে। এদিকে গত বছরের তুলনায় এ বছর উল্লেখযোগ্যহারে বিও হিসাব খোলার প্রবণতা কমেছে। নতুন করে হিসাব না খোলায় বাড়ছে না বিনিয়োগকারীর সংখ্যা। অন্যদিকে পোর্টফলিওর ইক্যুইটি মাইনাসে চলে আসায় যেসব বিনিয়োগকারীরা লেনদেন করতে পারছে না। ফলে ব্রোকারেজ হাউজগুলো কমিশন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

বর্তমানে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সদস্যভুক্ত ২৫০টি ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) ১৪৮টি ব্রোকারেজ হাউজ রয়েছে। এদের মধ্যে অধিকাংশ ব্রোকারেজ হাউজ উভয় স্টক এক্সচেঞ্জেরই সদস্য। এসব ব্রোকারেজ হাউজের এক হাজার ২০০—এর বেশি শাখা রয়েছে। যেখানে কমপক্ষে ১০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান আছে।

বাজার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১০ সালের ডিসেম্বরে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান মূল্য সূচক ডিজিইএন ছিল ৮ হাজার ৯১৮ পয়েন্টে। আর ৩ হাজার কোটি টাকার ওপরে লেনদেন হতো। আর বর্তমানে তা (ডিএসইএক্স) কমে ৪ হাজার পয়েন্টে নেমে এসেছে। লেনদেন হচ্ছে ৩০০ থেকে ৫০০ কোটি টাকার মধ্যে। এ অবস্থায় শেয়ারবাজার থেকে খুব একটা লাভবান হতে পারছেন না বিনিয়োগকারীরা। তাই ধীরে ধীরে বাজার ছেড়ে গেছেন অনেক বিনিয়োগকারী। অনেকে বিনিয়োগ কমিয়ে এনেছেন। এর প্রভাব পড়েছে শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্রোকারেজ হাউজগুলোতে লেনদেনের ওপর প্রাপ্ত কমিশনই তাদের আয়ের মূল অংশ। বর্তমানে লেনদেন অনেক কমে যাওয়ায় এ প্রতিষ্ঠানগুলোর আয় ব্যাপকভাবে কমে গেছে। ব্রোকারেজ হাউজের লেনদেন থেকে যে কমিশন পাওয়া যাচ্ছে, তাতে খরচের এক-তৃতীয়াংশের মতো ওঠে আসে।

ফলে মাসে প্রায় ৭০ শতাংশের মতো ভর্তুকি দিতে হচ্ছে বা লোকসান গুনতে হচ্ছে ব্রোকারেজ হাউজের মালিককে। লেনদেনের কমিশন থেকে প্রাপ্ত আয় দিয়ে ব্রোকারেজ হাউজ ও স্টক এক্সচেঞ্জ পরিচালনার জন্য অন্তত এক হাজার কোটি টাকার লেনদেন হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন স্টক এক্সচেঞ্জ কর্মকর্তারা। তা না হওয়ায় দিনে দিনে লোকসানের অংকটা বড় হয়ে যাচ্ছে ব্রোকারেজ হাউজগুলোর।

এ বিষয়ে ডিএসই’র সাবেক পরিচালক ও শাকিল রিজভী স্টকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শাকিল রিজভী বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরেই বাজার খারাপ যাচ্ছে। অনেক ছোট-বড়ও ব্রোকারেজ হাউজও লোকসানে রয়েছে। তবে ভবিষ্যতের ভালো হবে এমন আশায় তারা ব্যবসা করে যাচ্ছেন। তবে যদি কেউ একান্তই ব্যবসা করতে না পারেন বা পোষাতে না পারেন তাহলে প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে হতে পারে। হাজার কোটি টাকার লেনদেনের অপেক্ষায় অনেক ব্রোকারেজ হাউজ ধৈর্য্য ধরে আছেন। তবে করোনাভাইরাসের প্রভাব মোকাবিলায় শেয়ার বাজার বন্ধ রয়েছে। এর প্রভাব কতদিন থাকবে, সেটাই দেখার বিষয়’।

এ বিষয়ে ডিএসই’র সাবেক পরিচালক এবং মডার্ন সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) খুজিস্তা নূর-ই-নাহারিন (মুন্নি) বলেন, ‘ব্রোকারেজ হাউজগুলোর অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। বছরের পর বছর লোকসান গুনতে হচ্ছে। বর্তমানে ব্রোকারেজ হাউজগুলোর ব্যয় বহন করা কষ্টসাধ্য হয়ে গেছে। ফলে নিকুঞ্জে ডিএসইর নিজস্ব নতুন ভবন হওয়া সত্ত্বেও অনেক ব্রোকারজ হাউজ সেখানে যোতে পারছে না।

আমরা এখন ডিএসই থেকে পাওয়া ডিভিডেন্ডের টাকায় চলছি। সার্বিক প্রেক্ষাপটে ব্রোকারেজ হাউজগুলোর অবস্থা অনেক খারাপ যাচ্ছে। ইতোমধ্যে বেশ কিছু ব্রোকারেজ হাউজে কর্মী ছাঁটাইয়ের ঘটনাও ঘটেছে। বর্তমানে ডিএসইতে প্রতিদিন যে পরিমাণ লেনদেন হচ্ছে তা মোটেও স্বাভাবিক নয়। গত কয়েক বছর ধরে আমরা লোকসানে রয়েছি। হাজার কোটি টাকার লেনদেন হলে আমরা চলতে পারব।’

এ বিষয়ে ডিবিএ’র সহসভাপতি ও ঢাকা ব্যাংক সিকিউরিটিজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘বিগত কয়েক বছর ধরেই শেয়ার বাজার খারাপ যাচ্ছে। এর ফলে ব্রোকারেজ হাউজের ব্যবসা এমনিতেই খারাপ যাচ্ছে। এর মধ্যে করোনাভাইরাসের প্রভাব মোকাবিলায় বাজার বন্ধ রয়েছে।

ফলে সার্বিক প্রেক্ষাপটে ব্রোকারেজ হাউজগুলোর ব্যবসা বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়তে যাচ্ছে। বিগত কয়েব বছর ধরে কোনো মতে ব্যবসা টিকিয়ে রেখেছি ভবিষ্যতের আশায়। বর্তমানে অমরা ব্যবসা করে ব্রেকইভেন্টে আছি। তবে এভাবে চলতে থাকলে ক্ষতির মুখে পড়ব। বাজারে প্রতিদিন ৭০০ থেকে ৮০০ কোটি টাকার বেশি লেনদেন হলে আমরা টিকে থাকতে পারব।’