শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম. ঢাকা: অভিযুক্ত সিন্ডিকেটের কাছেই এখনো জিম্মি পুঁজিবাজার। চিহ্নিত এই কারসাজি সিন্ডিকেট কোনো কিছুর তোয়াক্কা করছে না। দিনের পর দিন একই ধরনের শেয়ার কারসাজি করে চলছে। সম্প্রতি পুঁজিবাজারে বড় ধরনের কারসাজির ঘটনায় তদন্ত প্রতিবেদনে যেসব ব্যক্তির নাম এসেছিল তারা এখনো নিয়ন্ত্রক কারসাজির।

প্রতিকারে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষও কোনো কিছুই করতে পারছে না। মামলা, জরিমানা করার পরও তাদের কারসাজি থামছে না। পুঁজিবাজারে এখন এদের পরিচয় শেয়ার কারসাজির মাফিয়া সিন্ডিকেট হিসেবে। এই সিন্ডিকেটের শীর্ষ পাঁচজন নিয়ন্ত্রণ করছেন সবকিছু।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মামলার বিচার না হওয়ায় বেপরোয়া এসব ব্যক্তি। জালিয়াতি, কারসাজি থামাতে হলে শেয়ার কারসাজির প্রমাণ পেলে এদের আজীবন নিষিদ্ধ করা উচিত। এ ছাড়া ক্ষুদ্র কোম্পানির শেয়ার আপলোডের ক্ষেত্রে বিএসইসির আরও সতর্ক হওয়া উচিত।

এদিকে হঠাৎ পুঁজিবাজারে ‘আলাদিনের চেরাগ’র ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে সাফকো স্পিনিং লিমিটেড। এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম বেড়ে প্রায় ৩০ শতাংশ ছাড়িয়েছে। একটি বিশেষ চক্র কারসাজির মাধ্যমে এ কোম্পানিটির শেয়ারের দাম এমন অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

পুঁজিবাজারে গুঞ্জন রয়েছে, শেয়ারের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ানোর লক্ষ্যে সম্প্রতি একটি ব্রোকারেজ হাউজে গোপন বৈঠক করেন। ওই বিনিয়োগকারীর নামের প্রথম অক্ষর ‘ব’। বৈঠকে ‘ব’ আদ্যাক্ষরের বিনিয়োগকারী শেয়ারের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিলে সাফকো স্পিনিং শীর্ষ কর্তা বলেন, ‘শেয়ারের দাম বাড়াতো পারলে আমাদের কোন আপত্তি নেই।

যে বিনিয়োগকারী সাফকো স্পিনিং শেয়ারের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়াতে প্রধান ভূমিকা রেখেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে, ওই বিনিয়োগকারীকে সম্প্রতি আরো কয়েকটি টেক্সটাইল শেয়ার কারসাজির অভিযোগ রয়েছে। তার উপর দুর্নীতি দমন কমিশনের নজরদারী রয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিএসইর এক সদস্য বলেন, সাফকো স্পিনিং মতো কোম্পানির শেয়ারহোল্ডারদের নিয়মিত ডিভিডেন্ড দেয়ার সক্ষমতা নেই সে কোম্পানির দর বাড়ার কারন নিয়ন্ত্রক সংস্থার তদন্ত করে দেখা উচিত।

তাছাড়া গত এক বছরের মধ্যে শেয়ারের দাম ১৮ টাকার ঘর অতিক্রম করতে পারেনি, সেই কোম্পানির শেয়ারের দাম ২৪ টাকা হওয়া কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারে না। হঠাৎ করে কী এমন ঘটলো যে শেয়ারের দাম এমন অস্বাভাবিক হারে বাড়বে! এর পেছনে নিশ্চয়ই কোনো কারসাজি চক্র আছে।

পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার বিষয়টি তদন্ত করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া উচিত। তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারী মাসের ১০ তারিখ থেকে শেয়ারের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। ১০ ফেব্রুয়ারীর কোম্পানিটির শেয়ারের দাম ছিল ১৭ টাকা ৯০ পয়সা।

যা টানা বেড়ে গত বৃহস্পতিবার লেনদেন শেষে দাঁড়িয়েছে ২৪ টাকা ১০ পয়সা। অর্থাৎ এক মাসেরও কম সময়ে প্রতিষ্ঠানটির প্রতিটি শেয়ারের দাম বেড়েছে ৬ টাকা ২০ পয়সা। এদিকে সপ্তাহজুড়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) লেনদেনে অংশ নেয়া ২৭ শতাংশ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিট দর বেড়েছে। শেয়ার দর সবচেয়ে বেশি বেড়েছে সাফকো স্পিনিংয়ের। ডিএসই সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

জানা গেছে, বিদায়ী সপ্তাহের প্রথম দিন লেনদেন শুরুর আগে সাফকো স্পিনিংয়ের শেয়ার দর ছিল ২০.৩০ টাকায়। আর সপ্তাহের শেষ দিন লেনদেন শেষে কোম্পানিটির শেয়ার দর দাঁড়ায় ২৪.১০ টাকায়। অর্থাৎ সপ্তাহের ব্যবধানে কোম্পানিটির শেয়ার দর ৩.৮০ টাকা বা ১৮.৭২ শতাংশ বেড়েছে। এর মাধ্যমে সাফকো স্পিনিং ডিএসইর সাপ্তাহিক গেইনার তালিকার শীর্ষে উঠে আসে।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ছোট মূলধনী কোম্পানিকে টার্গেট করে কারসাজি চক্র এসব কোম্পানির শেয়ার কেনেন। তারপর কয়েকদিন আস্তে দাম বাড়ান। এরপর বিক্রির সময় দাম বাড়ানোর জন্য বেশি দামে আরো কিছু শেয়ার কেনেন।

চক্রটি বাজারে গুজব ছড়ান যে, শেয়ারগুলোর দাম আরো বাড়বে। এই গুজবে কিছু বিনিয়োগকারীরা লাভের আশায় শেয়ারগুলো কেনেন। কারসাজি চক্র ঠিক তখনই তাদের হাতে থাকা শেয়ারগুলো বিক্রি করে বাজার থেকে টাকা তুলে নিয়ে যান। এদিকে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য গঠিত পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) কারসাজি চক্রের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নিচ্ছে না। হাত গুটিয়ে রয়েছে।

একই অবস্থা দেশের ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জেরও। প্রতিষ্ঠান দু’টিও নিরব ভূমিকা পালন করছে। তারা শুধু এসব কোম্পানির শেয়ারের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ার পেছনে কোনো কারণ আছে কিনা জানতে চেয়েছে। আর কোম্পানিগুলো তাদের উত্তরে জানিয়েছে দাম বাড়ার বিষয়ে তাদের কাছে কোনো মূল্য সংবদেনশীল তথ্য নেই। কিন্তু সার্ভেইলেন্স সফটওয়ার থাকার পরও এই কারসাজি চক্রের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কোনো রকম ব্যবস্থা নিচ্ছে না কোনো স্টক এক্সচেঞ্জ।

দুর্বল মৌলভিত্তি সম্পন্ন কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়ায় বিষয়ে ডিএসইর পরিচালক ও সাবেক সভাপতি শাকিল রিজভী বলেন, সব সময় স্মল পেইডআপ সম্পন্ন কোম্পানিতে কারসাজি হয়। এখানে অল্প শেয়ার কিনেই কারসাজি করতে পারে।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, কারসাজি করে দুর্বল মৌলভিত্তি সম্পন্ন কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়ানো চক্রের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় প্রতিনিয়তই বাজারে কারসাজি বাড়ছে। এতে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এর ফলে বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমছে। পাশাপাপাশি কমছে পুঁজিবাজারে মর্যাদাও। তাই বাজারে স্বার্থে এদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানান তিনি।

এ বিষয় যোগাযোগ করা হলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সাইফুর রহমান দেশ প্রতিক্ষণকে বলেন, ‘যে কোন কোম্পানির শেয়ারের দাম অতিরিক্ত হারে বাড়লে আমরা সার্ভিলেন্সের মাধ্যমে এর নজদারি করি এবং প্রয়োজন হলে বিশ্লেষণ করে তদন্ত করি। সাফকো স্পিনিং বিষয়টি আমাদের ওয়ার্ক লিস্টের মধ্যে আছে। তবে এখনও তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়নি।

২০০০ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়া সাফকো স্পিনিং পরিশোধিত মূলধনের পরিমাণ ২৯ কোটি ৯৮ লাখ ২০ হাজার টাকা। কোম্পানিটির মোট শেয়ারের সংখ্যা ২ কোটি ৯৯ লাখ ৮১ হাজার ৭১৬টি। প্রতিটি শেয়ারের ফেস ভ্যালু ১০ টাকা।
প্রতিষ্ঠানটির মোট শেয়ারের মধ্যে ৩০ শতাংশ শেয়ার রয়েছে উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের হাতে।

বাকি শেয়ারের মধ্যে ৬৯ দশমিক ৩৭ শতাংশ রয়েছে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে আছে শুন্য দশমিক ৬৩ শতাংশ শেয়ার। ২০১০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত গত আট বছরে কোম্পানিটি একবারও ক্যাশ ডিভিডেন্ড দেয়নি। এর মধ্যে ১৫ সালে নো ডিভিডেন্ড ঘোষণা করে। আর ক্যাটাগরি ধরে রাখার জন্য প্রতি বছর নামমাত্রা ডিভিডেন্ড দেয়।