emerald oilবিশেষ প্রতিনিধি, শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত খাদ্য ও আনুষিঙ্গক খাতের কোম্পানি এমারেল্ড অয়েলের উৎপাদন টানা ৬ মাস ধরে বন্ধ। তারপরও বৃহস্পতিবার প্রতিষ্ঠানটির ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের শেয়ার বিক্রি হয়েছে ৪২ টাকা ৮০ পয়সায় লেনদেন হয়। অথচ মাত্র ৫৪ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধনের এ প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ প্রায় ১১০ কোটি টাকা।

এছাড়া বিভিন্ন চালকলের কাছে কোম্পানির দেনা ১৫ কোটি টাকা। এমন নাজুক আর্থিক অবস্থার মধ্যেও প্রতিষ্ঠানটি বিনিয়োগকারীদের ২০ শতাংশ লভ্যাংশ দিয়েছে। এতে শেয়ারের দামও বেড়ে যায়। আর এ সুযোগে বোনাস শেয়ার বিক্রি করে বাজার থেকে ১৪ কোটি তুলে নেয়া হয়। এ তথ্য ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের।

এদিকে কোম্পানির বার্ষিক প্রতিবেদনে সম্পদের পরিমাণ দেখানো হয়েছে ২০৬ কোটি টাকা। পাশাপাশি কোম্পানিটির দায় দেখানো হয়েছে ২০৬ কোটি টাকা। এর অর্থ হচ্ছে কোম্পানির ইকুইটি শূন্য। এর আগে ১৭ জানুয়ারি কোম্পানির কারসাজি নিয়ে যুগান্তরে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এরপরই কারসাজির বিষয়টি সামনে আসে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এ ধরনের কাজ শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ বিষয়ে তদন্ত করে বিএসইসিকে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।

এদিকে ঋণ জালিয়াতির দায়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) করা মামলায় ২৮ মার্চ কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ হাসিবুল গনি গালিবকে গ্রেফতার করে গুলশান থানা পুলিশ। বর্তমানে তিনি জামিনে আছেন বলে দাবি করছেন কোম্পানি সচিব মেহেরুন্নেছা রোজি। তবে রহস্যজনক কারণে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে এর আগে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বিএসইসি।

জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির কোম্পানি সচিব মেহেরুন্নেচ্ছা রোজি বলেন, কোম্পানির অপারেশন কিছুদিন বন্ধ রয়েছে। তবে শিগগিরই আবার চালু হবে। এছাড়া অফিস বন্ধের ব্যাপারে তিনি বলেন, কর্মকর্তারা বাইরে মিটিং করছেন। আর কর্মকর্তারা না থাকায় পিয়ন দিয়ে অফিস খোলা রাখা যায় না। অফিস যথাসময়ে খোলা হবে বলে জানান তিনি।

তবে মহাব্যবস্থাপক আহসানুল হক তুষার বলেন, কোম্পানির উৎপাদন মাত্র দেড় থেকে ২ মাস বন্ধ। আগামী ১ আগস্ট থেকে উৎপাদনে যাব। তিনি বলেন, আমরা বিভিন্ন রাইস মিল থেকে কুঁড়া সংগ্রহ করে তেল বানাই। কিন্তু বর্ষা মৌসুমে তেল পাওয়া যায় না। এ কারণে উৎপাদন বন্ধ রাখা হয়েছে।

খেলাপি ঋণের ব্যাপারে তিনি বলেন, ডিসেম্বরের মধ্যে সব ঋণ পরিশোধ করা হবে। চালকলগুলো ১৫ কোটি টাকা নয়, মাত্র সাড়ে ৫ কোটি টাকা পাবে। অফিস বন্ধের ব্যাপারে তিনি বলেন, আমাদের কয়েকজন পরিচালকের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে। এজন্য আমাদের ঢাকার বাইরে মিটিং করতে হয়। তবে সোমবার থেকে অফিস চালু হবে।

emarald oil 1 grapসূত্র জানায়, প্রতিষ্ঠানটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১১০ কোটি টাকা। এর মধ্যে বেসিক ব্যাংকের ৭৪ কোটি টাকা, ব্যাংক এশিয়ার ২৫ কোটি টাকা এবং মাইডাস ফাইনান্সের ১৫ কোটি টাকা। অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানটি ঋণের টাকা পরিশোধ না করে বিনিয়োগকারীদের জন্য লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে।

এরপর কারসাজির মাধ্যমে শেয়ারের দাম বাড়িয়ে পরিচালকরা শেয়ার বিক্রি করে বাজার থেকে ১৪ কোটি ২৩ লাখ টাকা তুলে নিয়েছেন। এভাবে প্রতিষ্ঠানটি ঋণখেলাপি হয়ে মুদ্রাবাজারে সংকট সৃষ্টি করছে, অপরদিকে পুঁজিবাজার থেকে টাকা হাতিয়ে নিয়ে বিনিয়োগকারীদের নিঃস্ব করেছে।

জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম  বলেন, এ ধরনের কোম্পানির বিরুদ্ধে তদন্ত করে বিএসইসিকে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। না হলে বাজারে সুশাসন থাকবে না। কোনো কোম্পানি ঋণ পরিশোধ না করে লভ্যাংশ দেবে এটি গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ সবার আগের পাওনাদার হল ব্যাংক। আর শেয়ারহোল্ডাররা কোম্পানির মালিক। স্বাভাবিক নিয়মে পাওনাদারের ঋণ আগে পরিশোধ করতে হয়।

জানা গেছে, ২০১৪ সালের ১০ মার্চ বাজারে তালিকাভুক্ত হয় এমারেল্ড অয়েল। আর ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের এ প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারের দাম গত ৮ মাসে ৩০ টাকা থেকে ৭৮ টাকায় উন্নীত হয়েছে। এ হিসেবে আলোচ্য সময়ে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারের দাম ১৬০ শতাংশ বেড়েছে। ফলে বাজার মূলধন দাঁড়িয়েছে ৪২১ কোটি টাকা।

কিন্তু সর্বশেষ আর্থিক প্রতিবেদন অনুসারে এই প্রতিষ্ঠানটির ইকুইটি ৮০ কোটি টাকা। আর দীর্ঘমেয়াদি দায় ৮৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ দায় পরিশোধ করার পর শেয়ারহোল্ডারদের ইকুইটি ৯ কোটি টাকা ঘাটতি থাকবে। এর অর্থ হল উচ্চ আর্থিক লিভারেজের (ঋণজনিত ঝুঁকি) কারণে ভবিষ্যতে প্রতিষ্ঠানটি বড় ধরনের সংকটে পড়তে পারে। এমনকি দেউলিয়াও হয়ে যেতে পারে।

লভ্যাংশ বিতরণ : এদিকে ঋণখেলাপি থাকার পরও গত বছর তারা ২০ শতাংশ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে ১০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ এবং ১০ শতাংশ বোনাস শেয়ার। গত বছরের ২৮ অক্টোবর এ লভ্যাংশ ঘোষণা করা হয়। একই বছরের ১৫ ডিসেম্বর রাজধানীর ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউটে কোম্পানির বার্ষিক সাধারণ সভায় এ লভ্যাংশ অনুমোদন করা হয়। ইতিমধ্যে লভ্যাংশ বিতরণ শেষ হয়েছে।

পরিচালকদের কারসাজি : অস্বাভাবিকভাবে দাম বৃদ্ধির পর বোনাস শেয়ার বিক্রি করে বাজার থেকে টাকা তুলে নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটির উদ্যোক্তারা। ১৩ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠানটির ৪ উদ্যোক্তা ১৮ লাখ ২৫ হাজার ৫শ’ শেয়ার বিক্রি করেছে। আর ওইদিনের দাম অনুসারে এই পরিমাণ শেয়ারের বাজারমূল্য ১৪ কোটি ২৩ লাখ টাকা।

এর মধ্যে কোম্পানির চেয়ারম্যান সৈয়দ মনোয়ারুল ইসলাম ১ লাখ ৭০ হাজার ৫শ’, ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ হাসিবুল গনি ১১ লাখ ৬২ হাজার, উদ্যোক্তা মাহবুবুল গনি ৭৫ হাজার এবং ফারহানা গালিব ৪ লাখ ১৮ হাজার শেয়ার বিক্রির ঘোষণা দিয়েছেন। এর আগে গত বছরের মার্চে ৮ লাখ ৮৮ হাজার শেয়ার বিক্রি করেছেন ৫ উদ্যোক্তা। ওইদিন প্রতিটি শেয়ারের দাম ছিল ৪০ টাকা। এ হিসেবে ওই পরিমাণ শেয়ারের বাজারমূল্য দাঁড়ায় ৩ কোটি ৫৫ লাখ টাকা।

এর মধ্যে সজন কুমার বসাক ৫৫ হাজার শেয়ার বিক্রি করেছেন, সৈয়দ হাসিবুল গনি গালিব ৫ লাখ ৮১ হাজার, অমিতাভ ভৌমিক ৫৫ হাজার, সৈয়দ মাহবুবুল গনি ৩৭ হাজার ৫শ’ এবং ফারহানা গালিব এমি ২ লাখ ৯ হাজার শেয়ার বিক্রি করেছেন।

২০১১ সালে প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানটি রাইস ব্যান্ড তেল উৎপাদন করে বাজারজাত করছে। বতর্মানে প্রধান কার্যালয়ে ঢাকার বিজয়নগরে। বাজারে এদের পণ্যের নাম স্পন্দন রাইস অয়েল। আইপিওতে (প্রাথমিক শেয়ার) আসার আগে প্রতিষ্ঠানটির পরিশোধ মূলধন ছিল ২৭ কোটি টাকা।

এরপর আইপিওর মাধ্যমে শেয়ারবাজার থেকে ২০ কোটি টাকা নেয়। ফলে মূলধন দাঁড়ায় ৪৭ কোটি টাকা। পরবর্তীকালে দুই দফা বোনাস শেয়ার দেয়ার পর বতর্মানে প্রতিষ্ঠানটির পরিশোধিত মূলধন ৫৪ কোটি ২৯ লাখ টাকা।

এর মধ্যে উদ্যোক্তাদের কাছে প্রতিষ্ঠানটির ৫৫ দশমিক ১৭ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। তবে ২১ জন উদ্যোক্তার মধ্যে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাসিবুল গনি গালিব ও তার স্ত্রী ফারহানা গালিব এমির কাছে রয়েছে মোট শেয়ারের ৩২ দশমিক ০২ শতাংশ।

এছাড়া অন্য উদ্যোক্তারাও প্রায় একই পরিবারের সদস্য। এ হিসেবে পরিবারতান্ত্রিক কোম্পানিই এটি। অন্যদিকে উদ্যোক্তা শেয়ার ছাড়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে ১২ দশমিক ৩৬ এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে ৩২ দশমিক ৪৭ শতাংশ শেয়ার রয়েছে।

সর্বশেষ আর্থিক রিপোর্ট অনুসারে নেট অপারেটিং ক্যাশফ্লো ২ টাকা ৫৬ পয়সা নেতিবাচক। আর গত বছর প্রতিষ্ঠানটির প্রতি শেয়ারের বিপরীতে আয় ছিল ৩ টাকা ১০ পয়সা। কোম্পানিটির ইস্যু ম্যানেজার ছিল এলায়েন্স ফাইনান্সিয়াল সার্ভিস।